লাভ জিহাদের বলি হওয়া এক হতভাগ্য বোনের ভাইয়ের লেখা অশ্রুভেজা সেই চিঠি
মাননীয় রবীন্দ্রনাথ বাবু,
আপনার লেখা ‘নিঃশব্দ সন্ত্রাস’ বইটা আমার এক বন্ধুর মারফৎ পেয়ে বিশেষ মনোযোগ সহকারে পাঠ করে আমি এতই অভিভূত হয়েছি যে, বইতে দেওয়া ফোন নাম্বার যোগাযোগ করার ঠিকানা নিয়ে আপনাকে এই পত্র দিচ্ছি। আপনার বইতে আমার জীবনের একটা ঘটনার বাস্তব চিত্র আপনি অঙ্কিত করেছেন এবং আমাদের একটা পরিবার কিভাবে ধ্বংস হয়েছে তা আপনাকে জানিয়ে মনটাকে কিছু হাল্কা করার চেষ্টা করছি। আমার জন্ম নদীয়া জেলার একটি অতি প্রাচীন ব্রাহ্মণ বংশে। আমাদের পরিবার এতই নিষ্ঠাবান যে মাছমাংস তো দূরের কথা পেঁয়াজ-রসুন, মসুর ডাল ইত্যাদিও খাওয়া বারণ। আমার ঠাকুর-দাদা বেঁচে থাকতে পাঁজি-পুঁথি দেখে খাদ্য নির্বাচিত হতো; যথা- প্রতিপদে কুমড়ো, মাঘ মাসে মূলো, কুল ইত্যাদি ভক্ষন নিষেধ। তাছাড়া একাদশী, অমাবস্যায় নিশিপালন, বারোমাসে তেরো পার্বন। পূজা ব্রতকথা উপবাস ইত্যাদি তো লেগেই থাকত। ব্রাহ্মণ কন্যা ছাড়া আমাদের বাড়ীতে পরিচালীকা রাখা হতো না। নদীয়া, বর্ধমানের গ্রাম অঞ্চল থেকে গরীব ব্রাহ্মণ কন্যাদেরকে বেশী মাইনে এবং খাওয়া-পরা দিয়ে নিযুক্ত করা হতো। আমার পূর্বপুরুষদের অনেক শিষ্য অবিভক্ত বাংলার ভিবিন্ন জেল আসাম,মণিপুর ইত্যাদি অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। প্রতি বৎসর প্রচুর টাকা M.O যোগে বিভিন্ন সময় আসতো। আমার ঠাকুরদাদা যখন শিষ্য বাড়ীতে যেতেন তখন ব্রাহ্মণ পাচক সঙ্গে নিয়ে যেতেন। তিনি অন্য জাতির হাতের জল পর্যন্ত খেতেন না। এহেন গোঁড়া ব্রাহ্মণ পরিবারে আমার জন্ম।আমরা ভইবোন দুজনে যমজ; প্রথমে জন্মেছি বলে আমি বড়, তার কিছুক্ষন পরে জন্মেছে বলে বোন ছোট । দুজনে মায়ের দুই দুধ পান করে একই বিছানায় শুয়ে বড় হয়েছি । ভাইবোনের যখন কোন অসুখ হত তখন দুজনেই ঐ অসুখে আক্রান্ত হতাম। যথা জ্বর হলে একই টেম্পারেচার, পেট খারাপ হলে একই রকম পায়খানা ইত্যাদি। আমার বাবা-মা একজনকে ডাক্তারের চেম্বারে নিয়ে গিয়ে প্রেসক্রিপশান করিয়ে এনে দুজনকে একই ঔষধ খাওয়ালে রোগ নিরাময় হতো। ছোটবেলায় চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত দুজনে পাড়ার একই স্কুলে পড়েছি এবং সব বিষয়ে দুজনে প্রায় একই নম্বর পেতাম। তারপর উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত দুজনে আলাদা স্কুলে পড়েছি।
আমি ছেলেদের এবং বোন মেয়েদের স্কুলে পড়েছে। এরপর কলেজে দুজনে আবার একই কলেজ ভর্তি হই। সেই থেকেই আমাদের পরিবারে এক ভয়ানক বিপর্যয় আরম্ভ হয়। আমাদের কিছু সহপাঠী ছিল গ্রাম অঞ্চল থেকে আসা চাষী পরিবারের মুসলমান। সেই সুবাধে আমার বোন একটা গ্রাম্য মুসলমান সহপাঠীর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা আরম্ভ করে। প্রায় এক বৎসর এভাবে চলার পর আমার বোন ঐ মুসলমান ছেলেকেই বিয়ে করবে বলে মনস্থির করে ফেলে। শত বোঝানোর ফলেও তাকে ফেরানো যায়নি।ধীরে ধীরে এই সংবাদ বাবা এবং পরিবারের অন্যান্যদের গোচরীভূত হয়।ইতমধ্যে বোন সকলের প্রচন্ড বাধা অতিক্রম করে গৃহত্যাগী হয়ে ঐ মুসলমান সহপাঠীর বাড়ীতে চলে যায়। সামাজিক এবং লোকলজ্জার ভয়ে আমরা থানা পুলিশ বা তাকে উদ্ধারের কোন চেষ্টাই করিনি। মুসলমান পরিবার তাকে সাদরে গ্রহণ করে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করে তার বিবাহ সম্পূর্ণ করে। এরপর লজ্জায় এবং ঘৃণায় একমাস আর কলেজ যাইনি। এরপর কলেজে যোগ দিয়ে ঐ গ্রামের অন্য মুসলমান সহপাঠীদের নিকট আমার বোনের দুঃসহ জীবনের সংবাদ পেতে থাকি, যথা খাওয়া-দাওয়ার প্রচন্ড অসুবিধা। যে দিন গোমাংস রান্না হতো, সেদিন বমি করতে করতে অসুস্থ হয়ে পড়া, মুসলমান জীবনের মত নিয়ম, অষ্টপাশ বন্ধন, স্বামীর সাথে কোথাও বের হলে বোরখা পরা অবস্থায় চলাফেরা, পাঁচবার নামাজ পড়া ইত্যাদি তার অসহ্য হয়ে উঠে। কিন্তু এখন আর ফেরার কোন পথ নেই। আমাদের পরিবারে তার কোন স্থান হবে না তা সে বুঝতে পারে। সে আমাকে তার অনুতপ্ত জীবনের ঘটনা জানিয়ে গোপনে এক আত্মীয়ের বাড়ীর ঠিকানায় চিঠি দিয়ে সব জানায় এবং ক্ষমা প্রার্থনা করে। কিন্তু দুঃখ পাওয়া ছাড়া আমার আর কিছুই করার নেই। এরমধ্যে আরম্ভ হয়ে গেছে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রচন্ড অশান্তি। সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকতে হয় কখন না তালাক তালাক তালাক’বলে ঘাড় ধরে ঘর থেকে বের না করে দেয়। আমি তাকে উপদেশ দিয়ে পত্র দিতাম মানিয়ে চলতে। কারণ এখন বাড়ীতে ফেরার কোন উপায় নেই। বিয়ের পরেই তার স্বামী কলেজের পড়া ছেড়ে দিয়ে গ্রামে চাষাবাদে মন দেয় এবং মাঝে মাঝে বাইরে কোথাও গিয়ে কিছু কাজকর্ম করে বাড়ী ফিরে আসে। তার ৫ বৎসর বিবাহিত জীবনে সে ৪টি সন্তানের মা হয়। কিন্তু স্বামী- স্ত্রীর মনোমালিন্য এবং অশান্তি চলতেই থাকে। এরপর খবর পেলাম তার স্বামী বাইরে কোথাও চাকুরী নিয়ে চলে গেছে এবং আমার বোন এবং বাচ্চাদেরকে তার কর্মস্থলে নিয়ে গেছে। এরপর অনেক দিন আর কোন সংবাদ পাইনি। ভাবলাম এবার হয়তো বোন একটু সুখে-শান্তিতে আছে। কিছুদিন পর আমার এক আত্মীয়ের বাড়ীর ঠিকানায় খামে এক পত্র আসে আমার নামে। খাম খুলে চিঠিটি পড়ে জানতে পারলাম বোন এখন মধ্য ভারতের কোন এক শহরের এক গণিকালয়ে অবস্থান করছে এবং তার স্বামীই মোটা টাকার বিনিময়ে ষড়যন্ত্র করে দালাল মারফৎ তাকে সেখানে বিক্রি করে দিয়েছে। তার জীবনের জন্য তার কোন দুঃখ নেই। তার কৃতকর্মের ফল সে ভোগ করছে, কিন্তু তার চারটে সন্তানের জন্য সে ভয়ানক চিন্তিত। সে লিখেছে আমি যেন একটু খোঁজ করে দেখি তার সন্তানরা কোথায় কি অবস্থায় আছে।
আমার হৃদয়ের ব্যথা কাউকে জানাবার লোক নেই তাই আপনাকে দীর্ঘ এই পত্র লিখে মনের বেদনা কিছুটা হাল্কা করলাম। আপনি হিন্দু মেয়েদের মুসলমান বিয়ে করে দুরবস্থার কথা চিন্তা করে পরিশ্রম করে বইটা লিখেছেন। তার জন্য আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ জানাই।
ইতি, শ্রদ্ধাবনত.........
***********
(বিঃদ্রঃ- কোটেড অংশটি ‘নিঃশব্দ সন্ত্রাস’ নামক বই থেকে নেয়া)
No comments
Post a Comment